বাংলাদেশে এখন করোনা সংক্রমণের চতুর্থ মাস চলছে। আর এই চতুর্থ মাসে এসেই বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ নিয়ে টানা তৃতীয় দিনের মতো দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে।
মৃত্যুও হচ্ছে দিনে ৩০ জনের বেশি মানুষের। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যেও আমরা এমনটি দেখেছি যে, করোনা সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এসে সেখানে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।
আমরা যদি করোনার বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখবে যে, অধকাংশ দেশই সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এসে করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে অথবা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সুইডেনের মতো এই দেশগুলোতে আমরা এমনটিই দেখেছি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে আমরা দেখেছি শুরুতে তারা করোনাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এরপর চার মাসের মাথায় গিয়ে তাদের দেশ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের পথেই যাচ্ছে কিনা, সেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
করোনা শনাক্তের ৯০ দিন পার হওয়ার পর আমরা যখন চতুর্থ মাসে পৌঁছলাম তখন থেকেই করোনা রোগীর সংখ্যা দিনে ৩ হাজার অতিক্রম করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই এখন ৩ হাজারের বেশি রোগী আক্রান্ত হচ্ছে।
মৃত্যুর সংখ্যাও এখন ৪০ এর আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ৩৭, ৩৫, ৪০, ৪২- প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে এমন সংখ্যক মৃত্যু হচ্ছে। এই অবস্থায় যেকোনো সময় মৃত্যুর একটা তাণ্ডব শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরেকটা বিষয় যেটা বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা হলো, অনেক মানুষ এখন পরীক্ষার বাইরে থাকছে, লাইনে দাঁড়িয়েও পরীক্ষা করাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। অর্থাৎ উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরেও পরীক্ষ করাতে পারছেন বহু মানুষ।
আর উপসর্গ ছাড়াই যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা অবধারিতভাবেই পরীক্ষার আওত্র বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, আমাদের দেশে বড় একটা অংশই পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়েছে।
আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্তাগুলোর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, তারা শুরুতেই বলেছিল, ‘টেস্ট টেস্ট এবং টেস্ট’। অর্থাৎ করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদের বেশি বেশি করে টেস্ট করতে হবে।
প্রয়োজনে দেশের সবাইকে টেস্ট করাতে হবে। তারা এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল যে, পরীক্ষা যত কম হবে, করোনার ভয়াবহতা তত বাড়বে। কারণ যারা সংক্রমিত তারা সেটা নিশ্চিত হয়ে যদি বিচ্ছিন্ন না হয়, আইসোলেশনে না যায়, তবে তাদের মাধ্যমে আশা পাশের সমস্ত মানুষ আক্রান্ত হবে। ফলে সামাজিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা থেকে মুক্তির আরেকটি পথ বাতলে দিয়ে বলেছিল যে, কঠোর লকডাউন দিতে হবে। চীন, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পরামর্শগুলোই অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল এবং এর ফলও তারা পেয়েছে।
অন্যদিকে আমাদের দেশে আমরা দেখছি যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে টানা ৬৬ দিন নামেমাত্র সবকিছু বন্ধু রাখা হয়েছিল। সারা দেশের মানুষ ছুটি কাটাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। ফলে সারা দেশে সংক্রমণ ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
আর গত ৩১ মে থেকে সবকিছু খুলে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ করোনার উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এখন রাজাবাজারের মতো ক্ষুদ্র একটা এলাকায় লকডাউন করা হচ্ছে।
এটা আদৌ কোনো কাজের নয় বলে মনে করছেন তারা। কারণ এখন প্রতিদিন শতকরা ২০ শতাংশের কিছুটা কম বেশি হারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ সারাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন একটি দুটি এলাকা লকডাউন করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন যে, এমন যদি চলতে থাকে তাহলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, আমাদের পরিণতি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মত হতে পারে।
কারণ এই দেশেগুলোতেও শুরুতে ‘গা ছাড়া’ ভাব দেখানো হয়েছিল। এরপর ৪ মাস না যেতেই দেশগুলোতে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে করোনা। আর পঞ্চম মাসে গিয়ে দেশগুলো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল।
বাংলাদেশকে এই পরিণতি থেকে বাঁচাতে হলে অনতিবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো-
প্রথমত; সারাদেশে পরীক্ষা বাড়াতে হবে। কারণ দেশের সর্বত্র করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় করোনায় মৃত্যুও হচ্ছে। পরীক্ষায় যাদের করোনা পজিটিভ আসবে তাদের দ্রুত আলাদা করতে হবে। তারা যাদের সংস্পর্শে ছিল তাদেরকেও আলাদা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত; কঠোর আকারে লকডাউন দিতে হবে এবং সেটা একটি দুটি এলাকায় নয়, বরং সারা দেশে। এটা সম্ভব না হলে জেলাভিত্তিক, উপজেলা ভিত্তিক এভাবে লকডাউন দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত; সারা দেশেই করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেন ভ্যান্টিলেটর ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। নাহলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। করোনা চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য চিকিৎসাও যেন চলে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর কোনোটি করারই কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। আমাদের হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই, বেড নেই। রোগীরা চিকিতসা পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের মতো বাড়িতেই মারা গেছে অর্থাৎ তারা চিকিৎসা পায়নি। এমনটি চলতে থাকলে যুক্ততরাষ্ট্রের মতো ভাগ্য বরিওণ করে নেওয়া ছাড়া আমাদের হয়তো আর কোনো উপায় থাকবে না।